ছাগলের এলএসডি (লাম্পি স্কিন ডিজিজ) রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা
লাম্পি স্কিন ডিজিজ (Lumpy Skin Disease বা LSD) একটি ভাইরাসজনিত রোগ যা মূলত গবাদি পশুর মধ্যে দেখা যায়। এটি গরু ও ছাগল উভয়ের জন্যই গুরুতর, তবে ছাগলের ক্ষেত্রে এর তীব্রতা তুলনামূলক কম হতে পারে। এলএসডি রোগ ক্যাপ্রিপক্সভাইরাস (Capripoxvirus) দ্বারা সৃষ্ট এবং এটি মশা, মাছি, ও অন্যান্য পোকামাকড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। ছাগলের এই রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
লক্ষণসমূহ:
১. জ্বর:
আক্রান্ত ছাগলের শরীরের তাপমাত্রা ১০৪–১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত বেড়ে যায়।
জ্বর সাধারণত ১-২ দিন স্থায়ী হয়।
২. ত্বকের উপসর্গ:
ত্বকের ওপর গোলাকার ফোস্কা বা গুটি দেখা যায়।
গুটিগুলো কাঁধ, ঘাড়, মুখ, এবং পায়ের মতো জায়গায় বেশি হয়।
ফোস্কাগুলি শক্ত, ব্যথাযুক্ত এবং ধীরে ধীরে বড় হয়।
৩. ক্ষত সৃষ্টি:
ফোস্কা ফেটে যাওয়ার পর সেগুলো থেকে রক্ত বা পুঁজ বের হতে পারে।
ক্ষতস্থান থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে।
৪. লিম্ফনোডের ফোলা:
লিম্ফনোড বা লসিকাগ্রন্থি (বিশেষত ঘাড় এবং পায়ের) ফুলে যায়।
এটি স্পর্শ করলে ব্যথা অনুভূত হয়।
আরো পড়ুনঃ>>ছাগলের বসন্ত রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
৫. খাদ্যে অনীহা:
ছাগল খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারায়, ফলে ওজন কমে যায়।
পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
৬. অঙ্গহানি বা চলাফেরায় অসুবিধা:
ত্বকের ক্ষত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে।
হাঁটতে গেলে ব্যথা অনুভব করে।
৭. শ্বাসকষ্ট:
গলায় ফোস্কার কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হতে পারে।
৮. দুধ উৎপাদনে ঘাটতি:
যদি আক্রান্ত ছাগল দুধ উৎপাদনকারী হয়, তবে দুধের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
৯. গর্ভপাত:
গর্ভবতী ছাগলের ক্ষেত্রে গর্ভপাত হতে পারে।
১০. চর্মরোগ ও লোমপতন:
ত্বক শুকিয়ে যেতে পারে এবং লোমপতন দেখা দেয়।
রোগ সনাক্তকরণ:
ক্লিনিক্যাল লক্ষণ: উপরের উপসর্গগুলির উপস্থিতি।
পরীক্ষা:
পিসিআর (PCR) টেস্ট।
ভাইরাস আইসোলেশন বা সিরোলজিকাল টেস্ট।
ল্যাবরেটরিতে ত্বকের নমুনা পরীক্ষা।
প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ:
১. টিকা প্রদান:
ছাগলের জন্য LSD-র উপযোগী টিকা ব্যবহার করা।
ভ্যাকসিন সময়মতো দিলে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
২. পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ:
মশা, মাছি এবং অন্যান্য পোকামাকড় দূর করার জন্য কীটনাশক ব্যবহার।
আশপাশ পরিষ্কার রাখা এবং জলাবদ্ধতা দূর করা।
৩. আক্রান্ত পশু পৃথক করা:
আক্রান্ত ছাগলকে সুস্থ ছাগল থেকে আলাদা রাখা।
পৃথক থাকা অবস্থায় সংক্রমিত পশুর পরিচর্যা করার জন্য আলাদা সরঞ্জাম ব্যবহার।
৪. জীবাণুনাশক ব্যবহার:
খামার এবং পশুর আশপাশ জীবাণুমুক্ত রাখতে নিয়মিত জীবাণুনাশক প্রয়োগ।
খামারের সরঞ্জাম এবং যানবাহনও পরিষ্কার করা।
চিকিৎসা পদ্ধতি:
১. সাধারণ চিকিৎসা:
ভাইরাসজনিত হওয়ায় LSD-র নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই।
লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা (supportive therapy) প্রদান করা হয়।
২. জ্বর কমানোর জন্য:
প্যারাসিটামল বা অন্যান্য জ্বর কমানোর ওষুধ দেওয়া।
পশুচিকিৎসকের পরামর্শে ডোজ ঠিক করা।
৩. ব্যথা উপশম:
ব্যথানাশক ওষুধ যেমন ফ্লুনিক্সিন বা মেলোক্সিক্যাম ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. দ্বিতীয় সংক্রমণ প্রতিরোধ:
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ রোধ।
যেমন: অক্সিটেট্রাসাইক্লিন বা এনরোফ্লক্সাসিন।
৫. পুষ্টি সরবরাহ:
পানিশূন্যতা রোধে মুখে বা শিরায় তরল দেওয়া।
পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার সরবরাহ করা।
৬. ক্ষতস্থানের যত্ন:
ক্ষত পরিষ্কার রাখা।
অ্যান্টিসেপটিক বা জীবাণুনাশক মলম প্রয়োগ করা।
৭. ইমিউন সাপোর্ট:
ভিটামিন এ, সি, এবং ই সম্পূরক দিতে হবে।
খনিজ সম্পূরক যেমন জিঙ্ক এবং সেলেনিয়াম ব্যবহার।
৮. স্থানীয় চিকিৎসা:
ত্বকের ক্ষতস্থানে আয়োডিন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা অ্যান্টিসেপটিক স্প্রে করা।
পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার:
১. পুনরায় সংক্রমণ রোধ:
রোগমুক্ত ছাগলকে পুনরায় গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করার আগে পর্যবেক্ষণ করা।
অন্তত ২-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত পৃথক রাখা।
২. পর্যাপ্ত বিশ্রাম:
আক্রান্ত ছাগলকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে।
৩. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা:
অন্যান্য পশুর ওপর নজর রাখা এবং নতুন উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া।
মৃত্যুহার ও আর্থিক ক্ষতি:
LSD রোগে মৃত্যুহার সাধারণত কম, তবে তরুণ বা দুর্বল ছাগলের ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি।
রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণে আর্থিক ক্ষতি উল্লেখযোগ্য।
দুধ উৎপাদন ও প্রজনন ক্ষমতা কমে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করে।
পরিশেষে বলা যায় লাম্পি স্কিন ডিজিজ একটি গুরুতর রোগ যা ছাগলের স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সময়মতো সঠিক ব্যবস্থা নিলে রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ সম্ভব। খামারে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, টিকাদান, এবং দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই রোগের প্রভাব কমানো সম্ভব।
Comments
Post a Comment